Monday, 31 March 2014

(৭৬) এক ঋক্ষের ধৈর্য নিয়ে দিয়েগো রিভেরা

এক ঋক্ষের ধৈর্য নিয়ে দিয়েগো রিভেরা 
তাঁর তুলির ডগায় খুঁজে নেন বনের পান্না-গলানো রঙ, 
হৃৎ-গোলাপের সিঁদুর-উদ্ভাসন,
তোমার ছবিতে তিনি পৃথিবীর তাবৎ আলো ভরে দেন ।

তোমার অভিজাত নাক
তোমার চোখের চকিত বিদ্যুত
তোমার চাঁদের কলাকে ঈর্ষা-জাগানো নখ,
আর তোমার গ্রীষ্মময় ত্বকে তরমুজের মত সুশীতল, সুস্বাদু মুখ।

তোমার আগুন, ভালবাসা, আরাউকো-উত্তরাধিকার গেঁথে 
তিনি তোমাকে দুটি মাথা দেন, আগ্নেয়গিরির সোনালী লাভার মত,
আর উজ্জ্বল কাদাময় তোমার অবয়বের ওপর 

তিনি তোমায় বিস্ময়কর আগুনের শিরস্ত্রাণ পরিয়ে দেন:
ওখানেই আমার চোখ গোপনে অঢেল ছুটি নেয়,
তোমার ওই প্রাসাদের মত সুডৌল চুলের রহস্যময়তায়।

অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৪/০১

('With the patience of a bear, Diego Rivera', 76 in 100 Sonnets of Love, by Pablo Neruda)

(৬২) আমি দুঃখবান , আমরা দুঃখময়, প্রিয়তমা

আমি দুঃখবান, আমরা দুঃখময়, প্রিয়তমা,
পরস্পরকে ছাড়া, ভালবাসা ছাড়া কিছুই তো চাইনি
অথচ এত গভীর শোকের পরেও ভাগ্যলিখন
আমাদের ব্যথা দেয়, আবার... আবার ।

তোমার তুমিকে, আমার আমিকে চেয়ে, নিবিড় একটি চুম্বনে
সেই তুমিকে, একটি গোপন রুটির ভেতর সেই আমিকে পেয়ে
আমরা অসম্ভব এক সরল জীবন রচনা করেছিলাম
যতক্ষণ না জানালা দিয়ে ঘৃণার ঝাপটা এসে পড়ে।

যারা এই ভালবাসা দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়,
সমস্ত ভালোবাসাকে তারা কী আশ্চর্য ঘৃণা করে
একটি শূন্যময় ঘরে ভাঙাচোরা চেয়ারের মত

পাংশু, অর্থহীন, যতক্ষণ না তারা ভস্মীভূত হয়
যতক্ষণ না তাদের অশুভ গজব

সূর্যাস্তের আলো শুষে নেয় বেবাক।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/৩১

(`Woe is me, woe is us, my dearest', LXII from 100 Sonnets of Love, by Pablo Neruda)

Saturday, 29 March 2014

(৫) তোমার রাত্রি, বাতাস অথবা সূর্যোদয়

তোমার রাত্রি, বাতাস অথবা সূর্যোদয় আলিঙ্গন করিনি আমি,
শুধু ধরেছি তোমার মৃত্তিকা, থোকাথোকা ফলের পরম অস্তিত্ব,
জলের মিষ্টতা পান করে টুসটুসে হওয়া বৃতিমান আপেল,
তোমার সুরভিত গ্রামের কাদা আর বৃক্ষের আঠালো রজন।

তোমার চোখ যেখানে থেকে হেঁটে আসে, সেই আদি গ্রাম 
কুইন্চামালি থেকে ফ্রন্তেরায়, যেখানে তোমার যুগল পা আমার হৃদয় নাড়ায় 
তুমি সেই পরিচিত কালো কাদা আমার:
তোমার কোমর দু'হাতে ধরে ফের অনুভব করি ক্ষেতময় যবের ফসল।

আরাউকা থেকে জেগে ওঠা নারী, তুমি জানো কি 
তোমাকে ভালবাসার আগে কী ভাবে তোমার আদর বিস্মৃত থাকি
অথচ না জেনেই আমার হৃদয় হেঁটে যায়, তোমার মুখ মনে করে

শুধু হেঁটে যায়, একজন বিক্ষত মানুষের মত,
যতক্ষণ না উপলব্ধি করি ভালবাসা,
যতক্ষণ না সেই চুমু আর আগ্নেয়গিরি-সীমানায় পৌঁছই আমি

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/৩০

(`I did not hold your night, or your air, or the dawn', V from `100 Sonnets of Love' by Pablo Neruda)

Friday, 28 March 2014

(৭৯) রাত এলে, ভালবাসা, তোমার-আমার হৃদয়

রাত এলে, ভালবাসা, ঘুমের ভেতর তোমার-আমার হৃদয় 
একই সুতোয় গেঁথে আঁধার পরাস্ত করুক, গভীর বনান্তে 
দু'টি সুমেদুর দামামার মত
ভিজে পাতার দেয়ালের পুরু গায়ে, অবিরাম স্পন্দনে

রাতের ভ্রমণপথে ঘুমের লকলকে শিখা 
পৃথিবীর আঙুরলতা ছিন্ন করে দেয়,
একটি একরোখা রেলগাড়ির মত নির্ভুল ঘড়ির কাঁটায়
ছায়া আর পাথর ছিটিয়ে যেতে যেতে।

তাই ভালবাসা, আমাকে অন্য কোনো বিশুদ্ধ বেগের সংগে 
তোমার বুকের ধ্রুব ছন্দময়তায়, বেঁধে রাখো,
যে ভঙ্গিমায় জল কাটে রাজহাঁসের পাখার ঝাপট

তারপর, একটিমাত্র চাবি দিয়ে আমাদের ঘুম 
রাতের সমস্ত তারা-ঝলসানো প্রশ্নের উত্তর দিক, 
ছায়া-বন্ধ একটি দরজা খুলে।

- অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২৯

(`By night, Love, tie your heart to mine', 79 from `100 Love Sonnets' by Pablo Neruda)

Monday, 24 March 2014

(১) মাতিল্দে: একটি লতা অথবা বৃক্ষের নাম

                    (১) 

মাতিল্দে: একটি লতা অথবা বৃক্ষের নাম, বয়সী পাথর কিম্বা সুরভিত মদ 
যা কিছু শুরু হয় মাটির গহন থেকে, যা কিছু থাকে:
এমন একটি শব্দ যেখান থেকে সূর্যের অবাক উন্মীলন 
যার ঝলসানো আঁচে বিচ্ছুরিত হয় লেবুর আভা ।

যে নামের ভেতর দিয়ে পুরোনো জাহাজ ভেসে যায়  
আগুন-নীল ঢেউ যাকে ঘেরে 
যে নামের বর্ণমালা একটি নদীর মতন
আমার হৃদয়ের শুষ্কতায়, প্রপাত ঝরায় ।

আঙুরলতায় জড়ানো যে নাম ঝলমল করে,
গোপন শুঁড়িপথের মত বেবাক খুলে যায় 
পৃথিবীর অসীম সুবাসের দিকে!

তোমার তপ্ত মুখ যদি আমায় গ্রাস করতে চায়, তোমার রাত-জাগা চোখ
যদি খুঁজে নিতে চায়, তবে নিক। তবু তোমার নামের গহনে নাবিকের মত 
ভাসতে দাও আমায়, ওই নামের পালকে আমি ঘুমুতে চাই।

অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২৫ 

(`Matilde: the name of a plant', I from '100 Love Sonnets' by Pablo Neruda)

(১৫) পৃথিবী চিনেছে তোমাকে অনেক বছর

পৃথিবী চিনেছে তোমাকে অনেক বছর:
অখণ্ড রুটি অথবা এক টুকরো কাঠের মত 
কঠিণ তুমি, পদার্থময়, 
সোনাঝুরি গাছের ভারাক্রান্ত সোনালী ভেষজতা।

জানালার মত তোমার দু চোখ খুলে গেলে, যা কিছু আছে,
তার ওপর আলো পড়ে – তবু তোমার অস্তিত্বের পরিচয় এই শুধু নয়,
তুমি একতাল মাটির মত, কাদাময়, কঠিণ প্রতিমা
তুমি চিল্লানের আশ্চর্য ভাঁটার আগুন-ঝলসানো।

যা কিছু আছে, বাতাস, জলকণা অথবা হিম, গলে, উবে যায়।
যা কিছু আছে, আকারহীন, সময়ের স্পর্শে গুঁড়ো হয়,
ঝুরঝুর ভেঙে পড়ে, গত হয়, মৃত্যুর আগে।

কিন্তু আমার সঙ্গে তুমি অক্ষত পাথরের মত
কবরে পতিত হবে: কারণ আমাদের প্রেম
অজর, মৃত্যুহীন, মাটির মত, পৃথিবীর মত।
-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২৪

('The earth has known you for a long time now' - XV from 100 Love Sonnets by Pablo Neruda)

Saturday, 22 March 2014

(২) ভালবাসা, একটি চুম্বনে পৌঁছনোর কী দীর্ঘ পথ

            (২)
ভালবাসা, একটি চুম্বনে পৌঁছনোর কী দীর্ঘ পথ!
তোমাকে খুঁজে পাওয়ার আগে চলমান নিঃসঙ্গতা।
রেলগাড়িটি এখন, আমাকে ছাড়াই গড়িয়ে যায় বৃষ্টিতে,
তালতালে এখনো বসন্তের সূর্য ওঠেনি

অথচ তুমি, আমি, পোশাক থেকে শেকড় পর্যন্ত
আশরীর, আমূল আসঙ্গময়, 
আমাদের বেদনার জলে, হেমন্তের ধূসরতায়,
যতক্ষণ না আমরা একাকী থেকেও, নিবিড় হতে পারি।

বোরোয়ার দুর্বার মোহনা থেকে   
তামাম পাথর বয়ে আনার নির্মেদ শ্রম,
এত দেশ, রেলপথ আমাদের বিভাজিত করার পর, 
  
তাবৎ বিভ্রান্তি, পুরুষ, নারী, আর যে মাটিতে
দেবপুষ্প ফোটে, তাদের পেরিয়ে,
তবু মিলব বলে, শুধু ভালোবাসতে হয় পরস্পর।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২৩

(`Love, what a long way, to arrive at a kiss', II from "100 sonnets of Love'', Pablo Neruda)

*দেবপুষ্প - Carnation

(৪) মনে পড়ে সেই দুরন্ত নদ

মনে পড়ে সেই দুরন্ত নদ
সুগন্ধে কেঁপে ওঠা নরম মাটি,
একটি জল-ঝরা পাখিকে ঢেকে রাখা 
শ্লথতার কাপড়, শীতের পালক

মনে পড়ে সেই মাটির উপহার:
মায়াবী ঝাঁঝালো আঘ্রাণ, সোনালী কাদা,
জট পড়া জংলী আগাছা, আশ্চর্য শেকড়,
ছুরির মতন কাঁটা, জাদুময় 

মনে পড়ে তোমার হাতে পুঞ্জীভূত ফুলের স্তবক,
ছায়াময়, শান্ত, জলজ, 
ফেনা ঢাকা পাথরের মত।

সেই মুহূর্ত, খুবই নির্বিশেষ অথবা দারুণ অভিনব।
কেউ অপেক্ষা করে নেই বলেই আমরা গিয়েছি সেখানে;
অথচ, দেখেছি সব কিছু সেখানেই অপেক্ষায় আছে।

-অনুবাদ : আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২৩

`You will remember that leaping stream' - 4 of `100 Sonnets of Love',  by Pablo Neruda

(৯৪) যদি মরে যাই, অমিত দৃপ্ততায় জ্বলে যেন তুমি

যদি মরে যাই, অমিত দৃপ্ততায় জ্বলে যেন তুমি
রক্তশূন্য হিমে আগুন ধরিয়ে দাও
অজর চোখদুটো দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে
সূর্য থেকে সূর্যে মেলে রাখো, যতক্ষণ না তোমার কণ্ঠে বেজে ওঠে তামাম গীটার।

তোমার হাসি, পায়ের আওয়াজ যেন না থমকায়,
আমার আনন্দের উত্তরাধিকার বেঁচে থাক তোমার ভেতর।
আমার বুকে এসে খুঁজো না আমায়: আমি নেই,
আমার অবর্তমানের ঘরে, তুমি বাস করে যেও।

অবর্তমান এমন এক বিশাল ঠিকানা
যে বাতাসের শরীরেও ঘর সাজানো যায়
দেয়াল ভেদ করে যাওয়া যায় অন্য ঘরে।

অবর্তমান এমন এক স্বচ্ছ বাড়ি,
আমি মরে গিয়েও সেখানে দেখব তোমায়।
তুমি যদি কষ্ট পাও, সে-ই আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হবে।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২২

`If I die, survive me with such a pure force' - 94 from `100 Love Sonnets' by Pablo Neruda

(৭৩) হয়ত সেই ধারালো মুখের পুরুষ

হয়ত সেই ধারালো মুখের পুরুষকে তোমার মনে আছে 
যে একটি ছুরির ফলার মত আঁধার থেকে বেরিয়ে আসে,
আর আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, চিনে নেয়
কী আছে ওখানে: ধোঁয়া দেখে বুঝে নেয় আগুনের আঁচ।

সেই রক্তশূন্য নারী, যার চুল কালো 
গহন জলের ভেতর থেকে উঠে আসে মাছের মতন, 
তারপর দুজন মিলে দারুণ প্রহরায় 
ভালবাসার বিরুদ্ধে, আশ্চর্য এক ফাঁদ তৈরী করে।

তারা দুজন মিলে পর্বত আর ফুলের বাগান সাফ করে দেয়
নদীর খাদে নেমে, উঁচু দেয়াল বেয়ে 
পাহাড়ের ওপর প্রতিরোধের কামান দাগায় 

তারপর, ভালবাসা নিজেকে চিনতে শেখে।
আর তারপর, তোমার নামের দিকে চোখ তুলেই দেখি 
তোমার হৃদয় আমাকে আমার পথ বলে দিয়েছে, আগেই।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২২

'Maybe you'll remember that razor-faced man' - 73 from '100 Sonnets of Love' by Pablo Neruda.

Thursday, 20 March 2014

(৯) সমুদ্র যেখানে দুর্বার পাথরে আছাড় খায়

সমুদ্র যেখানে দুর্বার পাথরে আছাড় খায়
স্বচ্ছ আলো পাপড়ি মেলে হয়ে যায় গোলাপের স্তব 
যেখানে সাগরের বলয় ছোট হতে হতে কয়েকটি ফুলের স্তবক,
একটি গভীর নীল লবণের পড়ন্ত দানার মতন শেষ হয় 

যেখানে তুমি, ফেনার সাদায় ফুটে ওঠা চাঁপা
চৌম্বকীয়,  ভঙ্গুর
মৃত্যুর রহস্যে জন্মানোহারিয়ে যাওয়া, 
শূন্যময়, টুকরো লবণ, সমুদ্র-ঝলসানো ঢেউ।

তুমি-আমি, এই নীরবতাকে তবু আমূল পাল্টাই
যতক্ষণ সাগর তার জলজ ভাস্কর্য, দুরন্ত বেগ, 
সফেদ চুড়ো, নিজের হাতে তছনছ করে। 

কারণ ঢেউ-ওঠা অফুরান জল, ঝুরঝুরে বালি,
এইসব অদৃশ্য তাঁত দিয়েই তো 
আমরা আবিস্তার ভালবাসার পোশাক বুনে যাই।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/২০

(`There where the waves shatter on the restless rocks', IX from `100 Sonnets of Love' by Pablo Neruda)

Saturday, 15 March 2014

(৩৫) তোমার আঙুল আমার চোখের ওপর

তোমার আঙুল আমার চোখের ওপর দিয়ে 
উড়ে যায় দিনের দিকে। আলো এসে থরেথরে 
গোলাপের পাপড়ি খুলে দেয়। ফিরোজা মৌচাকের মত 
স্পন্দিত হয় একাকার হওয়া বালি আর আকাশ

তোমার আঙুল যে বর্ণমালা ছোঁয়, তা বেজে ওঠে, 
ঘণ্টার মত, সেই একই আঙুল ছুঁয়ে যায় পেয়ালা, 
সোনালী তেল ভরা পিপে, পাপড়ি, ঝর্ণা, প্রধানত, প্রেম।
তোমার হাত প্রেমের পানপাত্র পাহারা দেয়।

দুপুর ...আশ্চর্য নিথরতায় জেগে থাকে। রাত পিছলে চলে যায় 
একটি ঘুমন্ত পুরুষের চোখের ওপর দিয়ে, একটি অপরূপ ছোট আধারের মত।
মধুমালতী তার আদিম, বিষণ্ণ ঝাঁঝ বাতাসে ছড়ায়।

তখনই তোমার হাত পাখির মত কেঁপে উড়ে আসে আবার,
যে পালক হারিয়ে গেছে আমার কল্পনায়, সেই ডানা ছড়িয়ে দেয়
আমার আঁধার-গ্রাস-করা চোখের ওপর

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/১৬

`Your hand flew from my eyes into the day.' 35, from '100 Love Sonnets' by Pablo Neruda.

(৩৪) সমুদ্র-কন্যা তুমি, পাতার সুবাস

সমুদ্র-কন্যা তুমি, পাতার সুবাস,
তুখোড় সাঁতারু তুমি, পরিশুদ্ধ জলের শরীর
রাঁধুনি তুমি, মাটির ঝুরঝুরে চকিত রক্ত শিরায়,
তাবত ছোঁয়ায় তোমার, কী আশ্চর্য লেগে আছে পুঞ্জীভূত, মাটিময়, ফুল।

তোমার চোখ সমুদ্রে ধাবিত হলে তুমুল ঢেউ ওঠে 
তোমার হাত মাটিতে ডুবলে বীজ পুষ্ট হয় 
তুমি চেনো মাটি আর জলের গভীর নির্যাস
তোমার মধ্যে মিশে একাকার হয় কাদাময় জীবনের মুখ।

জল-পরী, গঙ্গাফড়িং, দেহটিকে নীলকান্তমণির মত ছিন্ন করে দাও,
তারা পুনর্জন্ম পায় ঠিক, তোমার রান্নাঘরে।
এভাবেই তুমি যা কিছু জীবন্ত তার আধার হয়ে থাকো।

এভাবেই তুমি ঘুমোও আমার বাহুর বৃত্তময় বৃতির ভেতর 
যখন সমস্ত ছায়াময় অন্ধকার সরে যায়:
যত ভেষজ কালচে উদ্ভিদ, শ্যাওলা আর স্বপ্নালু ফেনা।

অনুবাদ : আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/১৫

('You are the daughter of the sea, oregano's first cousin.' 34 in '100 Love Sonnets' of Pablo Neruda)

Thursday, 13 March 2014

(২৩) আলো নয়, পেয়েছি আগুন

আলো নয়, পেয়েছি আগুন । রুটি নয়, তেতো চাঁদ একফালি।
মল্লিকার গহন গন্ধে লুকোনো কান্না ঘিরেছে আমায়।
এক ভয়ার্ত ভালবাসার আকাল থেকে, দুটি সফেদ হাত
আমার চোখে শান্তিময় পালক বোলায়, আমার রন্ধ্রে পূরে দেয় সূর্যের ভাপ।

আহা, ভালবাসা, এত চকিতে তুমি আমার নগ্ন জখম জুড়িয়ে দাও
ছিন্ন শরীরে এনে দাও স্নিগ্ধ নিরাময়
আমাকে ঘিরে থাকা হিংস্র নখ হটিয়ে
দুজন হয়ে যাই এক অখন্ড জীবন

এমন হয়েছে, হয়, চিরকাল হবে, মাতিল্দে,
মধুর, বন্য ভালবাসা! যতদিন না সময়ের আঙুল
ধরে রাখে শেষ ফুল, বিদায় জানায়

সেই আলোহীনতায় তুমি-আমি থাকব না কেউ,
তবু, পৃথিবীর ছায়ার কিনারে, আঁধারের ফাঁকে
জেগে থাকবে এক যুগল ভালবাসা।


-অনুবাদ : আনন্দময়ী মজুমদার
২০১৪/০৩/১৪

(`The fire for light, a rancorous moon for bread', XXIII, from 100 Sonnets of Love, Pablo Neruda)

(৪৭) তোমাকে ফিরে দেখতে চাই অবারিত ডালে

তোমাকে ফিরে দেখতে চাই অবারিত ডালে
একটু একটু করে হয়ে-ওঠা তোমার ফলের আদল,
তপ্ত শেকড় থেকে কত সহজে উঠে আসো তুমি,
শব্দে
তোমার, অনুভব করি বনানীর গহন নির্যাস। 

তবু এখানে তুমি প্রথম এক মায়াবী
মুকুল
তারপর, এক মুহূর্তের নিথরতায়, জমে-যাওয়া চুম্বন,
যতক্ষণ না সূর্য আর পৃথিবী, রক্ত আর আকাশের আঁচ
তোমার মধ্যে সুখের 
প্রতিশ্রুতি, অমৃতের কলস ভরে দেয়। 

ডালে
কারুকাজে আমি চিনে নেবো তোমার কেশদাম,
পত্রালী আয়নায় ক্রমশ ফুটে ওঠা তোমার রূপরেখা
আমার তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে আসা তোমার পাপড়ির
সৌরভ। 

আমার মুখ ভরে উঠবে তোমার আস্বাদে
মাটি থেকে উন্মীল সেই চুম্বন, যে চুম্বনে লেগে আছে তোমার,
আর ভালবাসার সুডৌল ফলের রক্তিম ওম।

~অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার
২০১৪/০৩/১৩

(`I want to look back and see you in the branches' - XLVII from 100 Love Sonnets' -Pablo Neruda)

Wednesday, 12 March 2014

(৮) তোমার চোখে যদি চাঁদের রঙ থাকত না লেগে

তোমার চোখে যদি চাঁদের রং থাকত না লেগে,
কাদা-মাখা দিন, শ্রমের ঝলক, লালচে আগুন,
এই সব আঁচ, আভা না থাকত যদি, যদি এতটা জড়ানো থেকেও
না হতে তুমি বাতাসের মতো ফুরফুরে, শিল্পময়

যদি না হতে হলুদাভ বাদামী পাথর, হরি
 লহমার মতন 
যে লহমায় হেমন্ত আঙুরের লতা বেয়ে ওঠে
না হতে যদি সুগন্ধী চাঁদের আঙুলে ময়ান দেওয়া সেই অখন্ড রুটি
তোমার সাদা সুরভিত গুঁড়ো না ছড়াতে আকাশের গায়

তাহলে হয়ত, প্রিয়তমা, তোমাকে ভালবাসতাম না
ততটা, যতটা বাসা যায় । কিন্তু যে মুহূর্তে তোমাকে ছুঁয়ে থাকি, ধরে থাকি তোমায়,
সে মুহূর্তে যা কিছু আছে, সময়ের করতলে, তাই যেন পাই:

বালুকণা, মুহূর্ত-স্পন্দন, বৃষ্টি-ঝরানো বৃক্ষরাজি,
সব কিছু জীবন্ত, আমিও জীবিত তাই :
এসব অনুভব করি, নিষ্কম্প থেকে, 
তোমার জীবন আমাকে জীবন শেখায়।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার
২০১৪/০৩/১৩

(`If your eyes were not the color of the moon', VIII from '100 Love Sonnets of Pablo Neruda)

(২৯) তুমি অভাব থেকে এসেছ

তুমি অভাব থেকে এসেছ । দক্ষিণের গ্রাম,
এবড়োখেবড়ো,
পাথুরে 
নিসর্গ, ঠাণ্ডা, ভূমিকম্পময়, 
যেখানে মাটির বিগ্রহগুলি হুড়মুড় করে ধসে পড়লেও
আমরা জীবনের কাদা-মাখা পাঠ নিই।


একটি ছোট মাটির ঘোড়া, কালো কাদার আদর তুমি।
ভালবাসা, তুমি আমার এঁটেল পপী ফুল, সাঁঝবেলায়
উড়ে যাওয়া পায়রা। শত দারিদ্র্যেও
মৃত্পাত্রে ধরে রাখা শৈশবের সুখময় রুপালি পয়সা।
ছেলেবেলার অভাবী স্মৃতি তোমার হৃদয়ে
তোমার পায়ে যখন ফুটত কর্কশ পাথর,

তোমার জিভ পেত না রুটি অথবা আনন্দের স্বাদ


সেই দক্ষিণের মানুষ তুমি, যেখান থেকে আমারও সত্তা বেরিয়ে এসেছে।তোমার-আমার মা, এখন উঁচু আকাশে কোথাওরোদ্দুরে কাপড় শুকোতে দিচ্ছেন একসঙ্গে
এইজন্যে তো তোমাকে বেছে নিয়েছি, প্রিয়তমা!
-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার
২০১৪/০৩/১২

(`You come from poverty', XXIX from '100 Love Sonnets' - Pablo Neruda)

Friday, 7 March 2014

(৭১) ভালবাসা তার নিজস্ব দ্বীপ পার হয়

ভালবাসা তার নিজস্ব দ্বীপ পার হয়
এক দুঃখ থেকে অন্য বেদনায়, চোখের জলে সেঁচ দেওয়া
শেকড় চালায়। আর কেউ, কেউই,
হৃদয়ের শব্দহীন, সর্বগ্রাসী পদক্ষেপ থেকে রেহাই পায় না।

তুমি-আমি একটি বিস্তীর্ণ উপত্যকা, একটি ভিন গ্রহের খোঁজ করেছি
যেখানে লবনের তীব্রতা তোমার চুল স্পর্শ করবে না,
যেখানে আমার হাত বেদনা বাড়াবে না।
যেখানে এক খণ্ড রুটি বেঁচে থাকবে অমলিন।

এমন একটি খোলামেলা, জলময়, সবুজ গ্রহ,
যেখানে শুধু শক্ত সমতল, পাথর আর জনহীনতা:
পাখির মতন, নিজেদের হাতে একটি মজবুত বাসা তৈরী করতে চেয়েছি আমরা

যেখানে বেদনা নেই, আঘাত নেই, প্ররোচনা নেই।
কিন্তু ভালবাসা তো তেমন নয় : ভালবাসা একটি উন্মাদ নগরী
যেখানে বারান্দা থেকে, উঠোন থেকে, উপছে পড়ছে মানুষ।


-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/০৮

(`Love crosses its islands, from grief to grief', LXXI from 100 Sonnets of Love, by Pablo Neruda)

Thursday, 6 March 2014

(৬৫) মাতিল্দে, তুমি কোথায়? 

মাতিল্দে, তুমি কোথায়এইখানে, আমার 
হৃত্পিন্ডের ওপর, বুকের দুই পাঁজরের মাঝখানে, 
চকিত তোমার চলে যাওয়ার সাথে সাথে,
খেয়াল করি শোকের ঘাঁই মেরে ওঠা।

সে মুহূর্তে তোমার প্রাণের আশ্চর্য আলো চাই, 
চারিদিকে তাকিয়ে চাই আশা, বুভুক্ষুর মত পান করব বলে।
তোমাকে ছাড়া পোড়ো বাড়ির যে শূন্যতা, তার দিকে তাকিয়ে
দেখি দুঃখময় জানালা ছাড়া আর কিছু নেই।

শুধুমাত্র কথা বলবে না বলে বাকরুদ্ধ সিলিঙটা 
পাতা-হীন প্রাচীন বৃষ্টির শব্দ শোনে, শোনে ঝরা পালকের উড়ে যাওয়া 
রাতের কাছে আটক এটা-সেটার গুনগুন।  

তাই, একটি প্রাণহীন, শূন্যময় বাড়ির মতন তোমার অপেক্ষায় থাকি আমি।
যতক্ষণ না তুমি আসো, যতক্ষণ না আমার ভেতর বাস করো তুমি।
ততক্ষণ, আমার জানালাগুলি বেদনায় নীল হয়ে থাকে।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/০৭

('Matilde, where are you?'- LXV, from 100 Love Sonnets of Pablo Neruda)

Monday, 3 March 2014

(২৫) তোমাকে ভালবাসার আগে 

তোমাকে ভালবাসার আগে নিজের বলে কিছু ছিল না আমার।
রাস্তা আর সামগ্রীর ভেতর টালমাটাল হেঁটে
সব কিছু নামহীন, অপ্রয়োজনীয় মনে হত
পৃথিবীটা বায়বীয় ছিল, কার যেন অপেক্ষায় ।

কিছু ছাইময় ঘর ছিল, কোনো কোনো সুড়ঙ্গে, 
ছিল চাঁদের বসবাস। কিছু ভাগাড় ছিল, আমাকে চায়নি যারা, 
কিছু হানা-দেওয়া প্রশ্ন ছিল, বালির ভেতর; 
সব কিছু খাঁ খাঁ, মৃত, বোবা, ভাঙাচোরা ক্ষয়িষ্ণু, নির্জীব

পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে সবই আশ্চর্য অচেনা
অনাত্মিক মনে হয়েছেযেন এ সমস্ত অন্য কারুর
হয়ত বা, বেওয়ারিশ সম্পত্তি সব

যতক্ষণ না তোমার সৌন্দর্য্য, তোমার অভাব, এসব এসে 
হেমন্তর প্রকৃতিকে বাঙ্ময়, ভরন্ত করে তোলে 
যতক্ষণ না তোমাকে ভালবাসি আমি

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৩/০৪

(`Before I loved you, Love, nothing was my own', XXV from 100 Sonnets of Love - Pablo Neruda)

Sunday, 2 March 2014

(৭) বলেছিলাম, সঙ্গে এসো

বলেছিলাম, সঙ্গে এসো। কেউ জানত না ঠিক কোথায়, 
কেমন করে, আমার বেদনা ধুকপুক করে উঠছিল তখন  
আমার জন্য কোনো সুমধুর কার্নেশন বা নদীর বুক চিরে ওঠা দেহাতী সঙ্গীত 
ছিল না ; শুধু ছিল একটি অনাবৃত ক্ষত, ভালবাসার উপহার

বলেছিলাম, সঙ্গে এসো, যেন আমি বাঁচব না আর, 
কিন্তু কেউ আমার মুখের ভেতর নিঃশব্দ জ্যোৎস্নার রক্তপাত
দেখেনি তখন। ভালবাসা, তারার আলোয় যে কাঁটা থাকে, 
সে যন্ত্রণা এখন হয়ত আমরা ভুলতে পারি!

তাই তোমার গলায় ফের, `সঙ্গে এসো' শুনে আমার মনে হয়
তোমার তাবৎ জমে-থাকা শোক, ভালবাসা, উষ্ণ প্রস্রবন, 
ফুঁসে ওঠা মদের পুঞ্জীভূত ক্রোধ, সব যেন বেরিয়ে পড়েছে

আর আমার মুখের ভেতর তখন আবার আমি ফিরে পাই 
সেই আগুন, সেই রক্তপাতিত ফুল,
সেই কঠি পাথর, দগদগে স্বাদ ।

-অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 

(`Come with me, I said, and no one knew', VII from 100 Love Sonnets of Pablo Neruda)